Thursday, September 22, 2016

কেমন বাংলাদেশ চাই ?

সাব্বির আহমেদ-

        আগামীর বাংলাদেশ দেখতে চাই, পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্ত ও
প্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ দেশ। আগামীর বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলাদেশ এটাই
চাওয়া সকলের, যেখানে অপার সম্ভাবনা লুক্কায়িত রয়েছে। এ দেশের প্রতিটি
মানুষ হবে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক। প্রয়োজনে তারা মাতৃভূমি
রক্ষার্থে জীবনকে বিলিয়ে দেবে, যেমনটি বিলিয়ে দিয়েছিল ১৯৭১ সালে
স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য। এ দেশে থাকবে না
মানুষে-মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, থাকবে না সামাজিক কোন্দল, হত্যা, ধর্ষণ,
চুরি-ডাকাতি, লুটতরাজ ও চাঁদাবাজির মত ঘৃন্যতম অপরাধ। থাকবে শুধু
শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, যেখানে থাকবে না কোন অবৈধ
নিয়োগ-বাণিজ্য। একবিংশ শতাব্দীতে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় রাজতন্ত্র ও
স্বৈরাতন্ত্রের ভাঙা কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র সকল শ্রেণীর
মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছিলো। জাতি হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য এই যে,
আমরা স্বাধীন হওয়ার পরপরই গণতন্ত্র পেয়েছি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যদিও
আমাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে সফলতা অনেক তবুও অন্তহীন সমস্যার বোঝা
সকল অর্জনকে ম্লান করে দেয়। এ কারণেই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার পরও
স্বাধীনতার চার দশকের প্রত্যাশা, বাস্তবতা আর সম্ভাবনার হিসাব মেলালে
হতাশ হতে হয়।
       
সবুজ অভয়ারণ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি
বাংলাদেশ। এ দেশে রয়েছে বহু প্রাকৃতিক সম্পদ। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্পদ
হচ্ছে মানবসম্পদ। বাংলাদেশে প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমান ও ১০ ভাগ হিন্দু,
খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ বসবাস করে। যাদের মধ্যে রয়েছে
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বহুবার দেশের বাইরের ও
ভেতরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে দেশ এবং আজও বিভিন্নভাবে হচ্ছে। ১৯৫২
সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এ দেশের ছাত্র-জনতা মাতৃভাষা বাংলায় কথা
বলার অধিকার আদায় করেছে। পৃথিবীর কোথাও ভাষার জন্য এভাবে আন্দোলন করতে
আজো দেখা যায়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অর্জন
করে স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি
লাভ করতে সক্ষম হই আমরা। যাত্রা শুরু হয় সোনার বাংলার। কিন্তু স্বাধীনতার
৪৪ বছর অতিক্রম হওয়ার পরও এখনো আমরা সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারিনি।
দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সন্ত্রাসের রাজত্ব, সর্বক্ষেত্রে
দুর্নীতির মহোৎসব, জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার
প্রশ্ন, আইনের যথাযত প্রয়োগের অভাব এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির
সম্মুখীনসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের এই দেশ। এসব থেকে মুক্তি চায়
বাংলাদেশের মানুষ। বাংলার মানুষ এমন একটি বাংলাদেশ চায় যেখানে থাকবে না
রাজনৈতিক কলহ-দন্দ-সংঘাত, ছাত্ররাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস, শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলো হবে সোনার বাংলাদেশ গড়ার কারখানা, সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে
মুক্ত ও সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। দেশকে সামনে এগিয়ে
নিতে প্রয়োজন দলীয় নয়, যোগ্যতার মাপকাঠিতে মূল্যায়ন ও দুর্নীতিমুক্ত
বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। দেশের ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে
রূপান্তরিত করে দেশের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করে স্বনির্ভর বাংলাদেশ
গড়ে তুলতে হবে। বিভক্তি নয়, সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে ও দেশের স্বাধীনতা
সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে সকলের সহযোগিতার মাধ্যমে পৃথিবীর
মানচিত্রে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী ও আদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে
হবে।
        বিশ্ব-ব্রহ্মানের চিরন্তন বিধান অনুযায়ী আমাদের বারবার আশাহত হওয়ার
পেছনে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। আর এ কারণ স্বরূপ
সমস্যাগুলোকে সমাধানের পথে গতিশীল করা ছাড়া আমরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের
চিন্তাও করতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে জাতি হিসেবে আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য না থাকায় আমরা বারবার কুহেলিকার পিছনে ছুটেছি। আমাদের
অস্থিতিশীল ও পদহেলিত রাজনীতি সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে নীতিহীনতার বীজ বপন
করে দিয়েছে। দারীদ্রতা আমাদেরকে অনৈতিক করে তুলেছে, সুশিক্ষার অভাব
আমাদের মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিয়েছে। চূড়ান্তরূপে আমাদের সামাজিক,
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যার
দরুন গোটা বিশ্বে আমরা দুর্নীতিবাজ, তলাহীন ঝুড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠা
পেয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই যে, আমাদের সমাজের বুদ্ধিজীবী মহলের
একটি অংশ মনে করেন পশ্চিমা সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিকে এদেশে ব্যাপকভাবে
আমদানি করলেই সকল সমস্যা দূর হয়ে দেশটা ডিজিটাল হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে
সমস্যা কাটেনি, বরং আরো প্রকট হয়েছে। আসলে ‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’ এ
কথায় যদি আমরা আস্থা প্রকাশ করতে পারি তাহলে বলা যেতে পারে, নৈতিকতা ও
আধুনিক শিক্ষার মেলাবন্ধনের মাধ্যমে আমাদেরকে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে
হবে যারা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজে যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারবে। আর এ কাজ
শুরু করতে হবে এখনই। নইলে ‘বাংলাদেশীরা বাস্তববাদী নয়’ এমন দূর্নাম আমরা
কখনও ঘুচাতে পারব না। আজ আমাদের দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা
বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ করে রাখে। কেননা মনুষ্যত্ববোধের সহায়তায় বিবেক
উত্তর দেয়, সুন্দর একটি বাংলাদেশ চাই।
        ভবিষ্যতের দিনটি সুন্দরময় পেতে বিশ্বের দিকে এবং বাংলাদেশের বুকে আদর্শ
প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আমাদেরকে নিতে হবে। আদর্শবাদে যে সামাজিক
রাষ্ট্রীয় কাঠামো একদিন ভেঙে পড়েছিল, তা আবার জোড়া লাগলেও জনগণের সামাজিক
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসছে না, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে এবং
সরকার পদ্ধতিতেও এর বিকাশ ঘটাতে হবে। আগামী দিনের জন্য বিশ্বের যুবসমাজকে
জেগে উঠতে হবে। আধুনিক চাকচিক্যময়তা ও সংস্কৃতির নামে নগ্নতা ও অশ্লীলতার
মাধ্যমে আসা যুবসমাজকে তার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে অগ্রসর হতে
হবে। স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ বাস্তবায়িত করতে মানুষের কর্মনীতি হতে হবে হালাল
পথে যা কিছু উপার্জন করে তা বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত প্রয়োজন পূরণার্থে ব্যয়
করবে। এরপরও যা কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে তা অভাবগ্রস্থদের মাঝে দান করবে যাতে
তারা তাদের অপরিহার্য প্রয়োজনে ব্যয় করে।
        আগামীর বাংলাদেশে থাকতে হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যেখানে থাকবে না কোন
অস্থিতিশীলতা, রফতানিমূখর দেশীয় পণ্য ও চোরাচালানহীন সীমান্তপথ। আগামীর
বাংলাদেশ চাই অর্থনৈতিকভাবে প্রবৃদ্ধি সাধন, যেখানে থাকবে না শেয়ারবাজার
লুটতরাজ, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, সুদ-ঘুষ ও সীমাহীন দূর্নীতি। সকলে একে
অন্যের প্রতি আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল হবে। যে দেশে শুধু অপার সম্ভাবনা আর
সম্ভাবনার লক্ষ্য দেখা যায়- এটাই সকলের কাম্য।
                                                     লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
                                               
Share:

0 comments:

Post a Comment

Definition List

Unordered List

Support