সাব্বির আহমেদ :
‘আবিষ্কার নির্দিষ্ট কোনো স্থান বা পাত্রের জন্য নয়, তাই এর অপব্যবহারের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি ও সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে’। এর অপব্যবহার পৃথিবীর সব জায়গায়ই কম বেশি ঘটে। বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে মানুষ নানা ধরনের অপকর্মে ব্যবহার করছে। এ রকম অগণিত অপরাধমূলক কাজ আমাদের সমাজের নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। যার দরুণ একটি দেশের নাগরিকদের আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক অবক্ষয়ের হার বাড়ছে। এর প্রতিকার হিসেবে ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
সভ্যতার উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের শেষ পর্যন্ত কোন দিগন্তে নিয়ে যাবে সেটা ধারণার অতীত। প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধে কেড়ে নিয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর ৪২.২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। ধারণা করা হয় ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লোক ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসবে। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৫ সালের আগস্টে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি আট লাখ। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে যেটা বাংলাদেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি। অপরাধের একটা বড় অংশ এই সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়। মানুষের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত হানার মাধ্যম হিসেবে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো। মূল্যবোধ বিবর্জিত মানুষেরা প্রযুক্তিকে তাদের ভোগ ও আয়েশের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তথ্য বিকৃতি, ব্যক্তিগতভাবে সমাজের কোনো মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, প্রতিকৃতির ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপন ইত্যাদি বিষয় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া একটি নিত্য-নৈমিত্তিক কাজে পরিণত হয়েছে। অপরাধী চক্র তাদের অপরাধ কর্মকা সংঘটিত করার জন্য ইন্টারনেটকে গোপনীয় মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কম্পিউটারের তথ্য হ্যাকিং সম্পর্কিত ঘটনা বেশি ঘটছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গত ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের তথাকথিত হ্যাকার গ্রুপ ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার দ্বারা ভারতের প্রায় পঁচিশ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট আক্রান্ত হয়। এ গুলোর মধ্যে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটসহ বিএসএফের ওয়েবসাইটও ছিল। তা ছাড়া একই বছর কক্সবাজারের রামুতে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার পেছনে বৌদ্ধ ধর্মের এক ব্যক্তির নাম দিয়ে খোলা ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পবিত্র কোরআন শরিফের একটি অবমাননাকর ছবি প্রকাশ করা হয়। এই ঘটনার জের ধরে ওই এলাকায় সাধারণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। অথচ পরবর্তীতে ছবিটির সত্যতা যাচাই সম্ভব হয়নি। অনুসন্ধান করে দেখা যায় ছবি প্রকাশকারী ব্যক্তির বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা ছিল নিছক বানোয়াট এক ব্যাপার। সমাজে ঘটে যাওয়া এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা বস্তুত সামাজিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাইবার আক্রমণের শিকার বিশ্বের শীর্ষ দুইটি দেশ হচ্ছে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মজার ব্যাপার হলো সাইবার আক্রমণের উপকরণ মলওয়্যার, ভাইরাস, মাইএসকিউএল ইনজেকশন ইত্যাদির উৎপাদন এই দুইটি দেশেই তুলনামূলকভাবে বেশি। সমগ্র পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মলওয়্যার রাশিয়া থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো হয়। এ গুলোর ফলাফল হিসেবে বর্তমান পৃথিবীতে প্রতি দিনে প্রায় ছয় লাখেরও বেশি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায় ৫৯ শতাংশ চাকরিজীবী তাদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরও পুরাতন প্রতিষ্ঠানের ডেটাবেস থেকে তথ্য চুরি করতে তৎপর হন। যেহেতু তথ্য যুক্তিতে দক্ষ ব্যক্তিরাই এই অপরাধমূলক কাজ বেশি করে থাকেন সে ক্ষেত্রে তারা নিজেদের গোপনীয়তার ব্যাপারে বেশ সচেতন এবং পরিণামে তাদের অনেকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। বিশেষ করে ক্রেডিট কার্ডের গোপন নম্বর জেনে সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া সম্ভব।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সহজে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে পারে বলে কাউকে হুমকি দেওয়া ও ভুয়া সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়া অনায়াসে সম্ভব হয়। সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইন প্রয়োগ ও তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যা অনেকটা লাঘব করা সম্ভব। পাশাপাশি বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহারই পারে আমাদের একটি সুন্দর সমাজ উপহার দিতে।
সংগৃহীত পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে আমাদের সামনে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের শেষ পর্যন্ত কোন দিগন্তে নিয়ে যাবে সেটা ধারণার অতীত। এক পা দু পা করে আমরা সভ্যতার একেকটি স্তর পার হয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধে কেড়ে নিয়েছে। এ কথা আমি বলতে চাই না যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয়। সভ্যতার উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। কিন্তু আমরা কি কখনো অনুধাবন করে দেখেছি যে, প্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকগুলো আমাদের অবস্থান কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে? অবশ্য এর জন্য আবিষ্কার ও আবিষ্কারক কোনোটিই অপরাধী নয়, অপরাধী হচ্ছে আমরা, ব্যবহারকারীরা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
- See at: http://bhorer-dak.com/details.php?id=25722#sthash.btjwoEfe.dpuf